• শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪২৮
জুনিয়রদের স্বাগত না নির্যাতন!

নানারকম দুর্ঘটনার পর কিছু বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা নিয়েছে

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

ক্যাম্পাস র‌্যাগিং

জুনিয়রদের স্বাগত না নির্যাতন!

  • প্রকাশিত ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮

তন্ময় কুমার রায়

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের ভর্তি শেষ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে ভর্তি প্রক্রিয়া। কয়েক দিনের মধ্যেই তারা নতুন ক্যাম্পাসে পা রাখবেন। কিন্তু ক্যাম্পাসে প্রথম দিনেই র‌্যাগিং নামের নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে নবীন শিক্ষার্থীদের। দিন দিন এ অবস্থা বেড়েই চলেছে। এই র‍্যাগিংয়ের অপসংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলঙ্কস্বরূপ। র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে অনেক শিক্ষার্থী অপমান ও লজ্জায় আত্মহত্যা করেছেন এমন নজিরও আছে বিশ্বে।

জানা গেছে, র‌্যাগিং শব্দের প্রচলিত অর্থ ‘পরিচয়পর্ব’। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সিনিয়র শিক্ষার্থীদের প্রথম পরিচিতি পর্ব। এই পর্বকে র‌্যাগিং বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু বর্তমানে ক্যাম্পাসে যে র‌্যাগিং হচ্ছে তা এক কথায় টর্চার সেল। পরিচয়ের নামে সিনিয়র শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের হুকুম পালন করতে হয় জুনিয়রদের। কথা অমান্য করলেই শুরু হয় মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন। এর মধ্যে রয়েছে ‘সিনিয়র শিক্ষার্থীরা তাদের থুথু মাটিতে ফেলে জুনিয়রদের তা চাটতে বলে। কান ধরে ওঠবস। বড় ভাইদের পা ধরে সালাম করার মাধ্যমে সম্মান করতে বলে। অনেককে পুরো ক্যাম্পাস দৌড়াতে বলে। গানের সাথে নাচ বা কবিতা আবৃত্তি করতে বলে। আবার এসব করার সময় সিনিয়র গ্রুপের কেউ কেউ মোবাইলে ভিডিও করে এবং মজার জন্য সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। সব মিলিয়ে নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের কাছে র‍্যাগিং নিঃসন্দেহে নির্যাতন ও ভীতিকর।

ক্যাম্পাসে র‌্যাগিং নিয়ে অনেক গল্প শুনেছেন। হয়তো নিজেও শিকার হয়েছেন। এবার ক্যাম্পাস র‌্যাগিংয়ের অভিজ্ঞতা ও আনন্দের কিছু কথা শোনা যাক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তৌহিদুল হাসান। চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সে। বছরের শুরুতে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক পৈশাচিক আনন্দে তার মন নেচে ওঠে। মনে পড়ে তিন বছর আগের ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ভর্তি হয়ে গণরুমে উঠেছে। র‌্যাগিং নামক টর্চার সেলের জাঁতাকলে পড়ে সে। ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইয়েরা সেদিন তার সঙ্গে যা করল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সেদিনের কথা জীবনের কোনো দিনও ভুলতে পারবে না সে। দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনো তার বুকটা ব্যথায় ভরে ওঠে। তবে সেই দুঃখ আনন্দে পরিণত হয় যখন নতুন ভর্তি হওয়া কোনো ছেলেকে সে র‌্যাগিংয়ের চাকায় পিষ্ট করতে পারে। নতুন ছাত্রদের টর্চার করার মজাটা পেয়ে গেছে সেও!

এক বুক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে ভর্তি হয়েছে দেশসেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী আফরিন আক্তার। ক্লাস শুরু হওয়ার প্রথম দিনেই সিনিয়র আপুরা অনেকটা জোর করে তাকে নিয়ে যায় কমনরুমে। তার পরের কথাটা না বলাই আফরিনের জন্য ভালো। তার শত অনুরোধ, অনুনয়-বিনয়েও গলে না পাথর। ওদের হাত থেকে বেঁচে সে যখন কমনরুমে এলো, তখন সবাই বলল- এটা তো ট্রেইল মাত্র। ধারাবাহিক এপিসোড দেখবে কাল থেকে। সে দিনই বাড়ি চলে আসে সে। বাড়িতে এসেই সে জানিয়ে দেয়, আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে না।

র‌্যাগিংয়ে পিছিয়ে নেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। শাজিল রায়হান ভর্তি হয়েছে নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাসের প্রথম দিনেই সিনিয়র ভাইয়েরা ডেকে নিয়ে যায় তাকে। ডাকে সাড়া দিয়ে সেও পড়ে মহাবিপদে। নতুন সেমিস্টারে ভর্তি হওয়া প্রায় সব শিক্ষার্থী আছে সেখানে। সবাইকে নিয়েই হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠেছে সিনিয়র ভাইয়েরা। কথা অমান্য করায় অনেককে কান ধরে একপায়ে দাঁড়িয়ে রাখা হয়েছে। এ সময় পেছন থেকে তার  গায়ে ঢেলে দেওয়া হলো এক বোতল পানি। এতেই শেষ নয়, তার পরের কথা বলতে চাইল না সে।

শিক্ষাবর্ষের শুরুতে : সদ্য কলেজ শেষে যখন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রথম দিন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়ররা প্রস্তুত জুনিয়রদের স্বাগতম জানাতে। কিন্তু স্বাগতম জানানোর পদ্ধতি একটু ভিন্ন। এই র্যাগ ডে-তে উৎসবে মেতে ওঠে সিনিয়ররা। র্যাগ টর্চারের মূল হোতা মূলত তারাই। সুনির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখ নেই। সাধারণত শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার পর কোনো একদিন হঠাৎ শুরু হয় এই মর্মান্তিক নোংরামি, যা মেনে নিতে পারে না কেউই।

ইতিহাসের পাতায় : ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, র্যাগিং আসলে গ্রিক কালচার। সপ্তম-অষ্টম শতকে খেলার মাঠে টিম স্পিরিট নিয়ে আসার জন্য র্যাগিংয়ের প্রচলন শুরু হয়। র্যাগ শব্দটি মূলত ইংরেজি র্যাগিং থেকেই এসেছে। আর ইউরোপে এর প্রচলন ঘটে অষ্টম শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ১৮২৮-৪৫ সালের দিকে র্যাগ সপ্তাহের প্রচলন ঘটে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বিশেষ করে ছাত্রসংস্থা পাই, আলফা, বিটা, কাপ্পা এই সপ্তাহটির প্রচলন ঘটাতে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। তবে মজার ব্যাপার হলো, ইউরোপ-আমেরিকায় যাত্রা হলেও বর্তমানে আমাদের এই উপমহাদেশেই এর ব্যবহার সর্বাধিক। বিশেষ করে ভারতে র্যাগিং এখন চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে।

মানসিকতায় তালগোল : বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব ছাত্রছাত্রী পড়তে আসে, তাদের বেশিরভাগই মফস্বল বা অন্য শহরের। আধুনিক দুনিয়ার সঙ্গে তাদের পরিচয়-আলাপ সীমিত। ফলে র্যাগ ডে বিরাট প্রভাব ফেলে তাদের ওপর। হঠাৎ তারা যখন এমন একটি অবস্থানের মুখোমুখি হয়, তখন স্বভাবতই আঁতকে ওঠে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয় তখন। অনেকেরই মানসিক শক্তি ভেঙে যায়। ফলে আত্মহত্যার মতো ঘটনারও সূত্রপাত হয় এই র্যাগিং থেকে। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সারাজীবনের জন্য নিজেকে বন্ধুহীন করে তোলে। কেউবা এর প্রতিশোধ নিতে অপকর্মেও জড়িয়ে পড়ে। আর সবচেয়ে কমন যে প্রতিক্রিয়া তা হলো, পরবর্তী বছর সে হয়ে ওঠে প্রতিশোধপরায়ণ। নতুন ছাত্রছাত্রীরা আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর চড়াও হয় সে।

ভালোর মোড়কে : নানারকম দুর্ঘটনার পর কিছু বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা নিয়েছে। আশা করি, অচিরেই ক্যাম্পাস থেকে দূর হয়ে যাবে কষ্ট, বেদনা আর দুঃখ। এমন চাওয়াটা জুনিয়রদের মতো বড় ভাইদেরও হোক। তারাও যেন নিজের অতীত থেকে ইতিবাচক শিক্ষাটা নেয়। বলাই বাহুল্য, এটা সত্যিকার অর্থেই কোনো ভালো চর্চা নয়। স্বপ্ন বুকে নিয়ে ক্যাম্পাসে আসা স্বপ্নবাজ ছোট ভাই-বোনদের প্রতি আমরা হবো আরো সহজাত এবং কোমল। আমাদের প্রত্যাশা, র্যাগিং নামের নোংরা সংস্কৃতি বন্ধ হোক।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads